প্রথম এপিসোড থেকেই সেই উত্তরণের পথে যেতে মন্দ লাগে না দর্শকদের৷ তাল কাটতে শুরু করে টোটা রায়চৌধুরীর সংলাপ উচ্চারণে৷ তিনি শীর্ষাসনে যতটা দক্ষ, সেই পারদর্শিতার কিছুটা কাজে লাগিয়েও যদি বাচনঙ্গিতে সামান্য পরিবর্তন আনতেন, নৈরাশ্যের পাল্লা হালকা হত অনেকটাই৷ বরং, এই সিরিজে জটায়ু এবং তোপসে বেশ সপ্রতিভ৷ এখানে লালমোহনবাবু ষোলআনাই প্রদোষ সি মিটারের পায়ে নিবেদন করে বসে নেই৷ তিনিও টুকটাক রক্তবরণ মুগ্ধকরণ কিছু প্রত্যুত্তর ফিরিয়ে দেন সন্ধ্যাশশী বন্ধুকে৷ বিশেষ করে মার্তণ্ড মন্দিরে তোপসে-জটায়ুর সিকোয়েন্স ভাল লাগার মতোই৷ যে প্রজন্ম গোয়েন্দা একেনবাবুর চরিত্রে অনির্বাণ চক্রবর্তীকে দেখে অভ্যস্ত, তাঁদের চোখে কিঞ্চিৎ স্মার্ট জটায়ুকে দেখলে হোঁচট হয়তো কম লাগে৷ অন্য এক হোঁচট অবশ্য অপেক্ষা করে আছে প্রথম দৃশ্যেই৷ ১৯৮৯ সালের ভূস্বর্গে কি রিমোট চালিত টেলিভিশনসেট ছিল? সেটাও নয় মেনে নেওয়া গেল৷ কিন্তু হোরেশিওকে বলা হ্যামলেটের সেই অমোঘ উক্তি সম্পর্কে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক সম্পূর্ণ অজ্ঞ? সবই তাঁর সিলেবাসের বাইরে? নাকি গল্পের কেন্দ্রে থাকা পিতা-পুত্রের সম্পর্ক-প্রতিহিংসা-প্রতিঘাতের দ্বন্দ্বকে আরও আবর্তিত করতেই তাঁর সামনে ‘হ্যামলেট’ শব্দটা বলানো? বাবা ছেলের সম্পর্কের টানাপড়েন, মৃত্যুদণ্ডের প্রাসঙ্গিকতা ঘিরে দানা বেঁধেছে যে রহস্য, সে গল্প সত্যজিৎ-পাঠকদের বিলক্ষণ জানা৷ শ্রোতারাও এতদিনে গল্প জেনে গিয়েছেন অডিও বুকের দৌলতে৷ তাই বহুচর্চিত ফেলুকাহিনি পর্দায় পেশ করতে যে মুনসিয়ানার দরকার, তার ছাপ এই ছবির সর্বত্র৷ পরিচালক অবিকল পাতার পর পাতা গল্প বই থেকে পড়ে যাননি৷ আবার মূল কাহিনীর প্রতি আনুগত্যও হারাননি৷ কাশ্মীরের পহলগাঁওতে লিডার নদীর পাশে তাঁবুতে অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে খুন ও তার বহুমূল্য হিরের আংটি চুরির রহস্যের পরতে পরতে শেষ পর্যন্ত বজায় ছিল রোমাঞ্চ এবং টান টান উত্তেজনা। এর আগের ফেলুদা-সিরিজেও সত্যজিৎ রায়কে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেছেন সৃজিত৷ কাশ্মীর কান্ডও তার ব্যতিক্রম নয়৷ এই ছবিতে ফেলুদা বরফসাদা হিমালয় দেখে একই কথা বলছে যেমন ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে বলেছিল গুপী গাইন৷ তার গানই আবৃত্তি করেছে ফেলুদা৷ রচয়িতার নাম হিসেবে জটায়ু যখন ‘রবীন্দ্র-নজরুল’-এর নাম বলছেন, তখন মৃদু মাথা নেড়ে ফেলুদার উত্তর ‘কাছাকাছি’৷ এ দৃশ্য সিকোয়েন্স হিসেবে ভাল৷ কিন্তু টোটার আবৃত্তির সময় মনের কানে ভাসে অনুপ ঘোষালের কণ্ঠের গানটিই৷ এছাড়াও গল্পে বার বার এসেছে সত্যজিতের একাধিক কাজের উল্লেখ৷ শুধু প্ল্যানচেটের বুজরুকি প্রসঙ্গে ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’, ‘গোঁসাইপুর সরগরম’-এরও উল্লেখ থাকলে আরও নিশ্ছিদ্র হত চিত্রনাট্য৷ এছাড়া গল্পের দাবিতে ফেলুদার অন্যান্য কীর্তির বিশেষ মুহূর্তের দৃশ্যায়নও এখানে দিব্যি মানানসই৷ তিলেক সুযোগে মগনলাল মেঘরাজের ভূমিকায় নিজের এক্সট্রা আর্ডিনারি অভিনয় প্রতিভার ছাপ রেখেছেন খরাজ মুখোপাধ্যায়৷ নানা জটিলতায় মেঘরাজের চরিত্রে খরাজকে নিয়ে ‘যত কান্ড কাঠমান্ডুতে’ ওটিটি প্ল্যাটফর্মে এখনও না আসার দীর্ঘশ্বাস আরও গভীর হল৷ আরও পড়ুন : অনীকের পরিচালনা ও জিতুর অভিনয়ে শতবর্ষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নামেও ‘অপরাজিত’, কাজেও অপরাজিত আগাথা ক্রিস্টির বিখ্যাত থ্রিলার ‘অ্যান্ড দেন দেয়ার ওয়্যার নান’-এর বিপরীত প্রচ্ছায়া ছোঁয়া এই ফেলুদা অ্যাডভেঞ্চারে গত শতকের আটের দশকের শেষভাগের কাশ্মীরকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টার কোনও খামতি নেই৷ অসামান্য কারিগরিতে আনা হয়েছে উগ্রপন্থার মতো বিষয়কে৷ কিন্তু এই সংযোজনে নষ্ট হয়নি গল্পের স্বাদ বা মেজাজ৷ চিত্রনাট্যে অভাব ছিল না সহজাত রসবোধেরও৷ ফেলুদাকে ‘রহস্যের কুণ্ডু স্পেশ্যাল’ বলেছে জটায়ু। উত্তরে ফেলুদার আর্জি, ‘থমাস কুক’-ও তো বলা যায়! এছাড়াও সংলাপের ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ‘আমির খসরু’-কে ‘খুচরো সাহেব’ বলা থেকে শুরু করে ‘কালাশনিকভ’-এর মধ্যে জটায়ুর কৈলাস সংযোগ খুঁজে পাওয়া। অভিনয়ের ক্ষেত্রে টোটা রায়চৌধুরী, কল্পন মিত্র এবং অনির্বাণ চক্রবর্তীর সঙ্গে বলতেই হয় রজতাভ দত্ত, দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এবং ঋদ্ধি সেনের কথা৷ শিকারার কারুকাজ, তাঁবুর অন্দরমহল থেকে জটায়ুর কাঁধের ঝোলায় ঘুরেফিরে এসেছে বাঙালির চিরচেনা কাশ্মীরি সূচিশিল্প৷ অভিনেতাদের পরনে থাকা কাশ্মীরি শালও নজর কেড়েছে৷ নিখুঁত শিল্প নির্দেশনাকে আরও অর্ঘ্যপূর্ণ করেছে স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের পুলিশ অফিসারের চরিত্রের ‘বংশী চন্দ্রগুপ্ত’ নামকরণে৷ পাকিস্তান ও কাশ্মীরে শিকড় ফেলে আসা এই শিল্পী তথা শিল্প নির্দেশকের হাতের জাদুতে সেজেছে সত্যজিতের মণিমুক্তোসম একের পর এক ছবির সেট৷ তাঁদের যুগলবন্দি বজায় ছিল ‘নায়ক’-সহ ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ পর্যন্ত৷ যদিও অধিকাংশ দর্শকের কাছে তিনি বঙ্গসন্তান ‘বংশীচন্দ্র গুপ্ত’ হয়েই আছেন৷ আরও পড়ুন : দেখো রে নয়ন মেলে অভিনবের অভিনয়! কিন্তু কতটা জমল ফেলু মিত্তিরের মগজাস্ত্রের অভিযান? অন্দর-দৃশ্য বাদ দিলে যখনই কাশ্মীরের ল্যান্ডস্কেপ এসেছে, তখনই যেন একমুঠো তুঁতে আবির ছড়িয়ে পড়েছে পর্দায়৷ এই অতিরিক্ত নীল আভায় একটু চোখ কড়কড় করেছে বৈ কী! ঠিক যেমন চোখে লেগেছে রহস্যের শেষ পর্যন্ত লাল পাগড়ি-সানগ্লাস পরা এক ‘তাসুড়ে জুয়াড়ি’-র অনাবশ্যক নীরব উপস্থিতি৷ মূল গল্পে অনেক আগেই বিদায় নিয়েছিল সে৷ এ সব খুচরো চোখের বালি দূর হয়ে যায় আবহে সুপ্রাচীন বাদ্যযন্ত্র রবাবে আদি অকৃত্রিম ফেলুদা টিউন শুনে৷ None
Popular Tags:
Share This Post:
What’s New
Spotlight
Today’s Hot
-
- January 6, 2025
-
- January 6, 2025
-
- January 6, 2025
Featured News
Latest From This Week
Bankura News: বিষ্ণুপুরের অপূর্ব শিল্পকলা! দেখে হতবাক জার্মান পর্যটক
NEWS
- by Sarkai Info
- January 6, 2025
Subscribe To Our Newsletter
No spam, notifications only about new products, updates.